তাকওয়া অর্থ হচ্ছে বাঁচা, আত্মরক্ষা করা, নিষ্কৃতি লাভ করা।
হযরত উমর (রা.) একবার হযরত কা’ব (রা.)-এর কাছে তাকওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে কা’ব (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি কখনও কণ্টকময় পথে হেঁটেছেন?” হযরত উমর (রা.) হ্যাঁ বললে তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি সেই পথ কিভাবে পার হন?” হযরত উমর (রা.) উত্তরে বললেন যে তিনি খুব সন্তর্পনে নিজের কাপড় গুটিয়ে সেই রাস্তা পার হন যেন কোনভাবেই কাঁটার আঘাতে কাপড় ছিঁড়ে না যায় অথবা শরীরে না বিঁধে। হযরত কা’ব উত্তরে বললেন যে, “এটাই হল তাকওয়া। দুনিয়ার জীবনে নিজেকে সমস্ত গুনাহ থেকে এভাবে বেঁচে চলাই হল তাকওয়া”।
ন্যূনতম অর্থে ‘তাকওয়া’ অর্থ ভাল-মন্দের স্বাভাবিক জ্ঞান। একজন সুস্থ সামাজিক মানুষের মধ্যে ভাল থেকে মন্দকে, ন্যায় থেকে অন্যায়কে পৃথক করার যে স্বাভাবিক চেতনা আছে সেটাই ‘তাকওয়া’। কিন্তু মানুষ শয়তানের কুপ্ররোচনায় এবং স্বার্থের হাতছানিতে অন্ধ হয়ে যখন ভাল আর মন্দ, ন্যায় আর অন্যায়কে একই বিষয় বলে মনে করতে থাকে তখন সে ‘তাকওয়া’ হারায়।
সুরা আল-বাকারাতে বলা হযেছে, “এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। এটি মুত্তাকীদের জন্য পথ প্রদর্শক”। [ সুরা বাকারা ২:২]
আল-কুরআন যে কতটা উদার তা এই আয়াত থেকেই বোঝা যায়। কুরআন তার একেবারে শুরুতেই মানুষের স্বভাবজাত ভাল-মন্দ জ্ঞান, ন্যায়-অন্যায় জ্ঞানের উপর আস্থা রেখেছে। বলা হচ্ছে যাদের মধ্যে ‘স্বভাবজাত ভাল-মন্দের জ্ঞান ও ন্যায়-অন্যায়ের জ্ঞান’ আছে (অর্থাৎ তাকওয়া আছে) কেবল তারাই এই কিতাব থেকে হেদায়াত বা সু-পথ প্রাপ্ত হবে। যাদের মধ্যে ‘তাকওয়া’ নেই তারা এই কিতাব থেকে কোনো উপকার পাবে না।
মানুষ যখন শয়তানের কুপ্ররোচনায় পড়ে তখনই সে তাকওয়া হারায়। ফলে তার জন্য সু-পথ পাওয়া সুদুর পরাহত। আর এই শয়তান আমাদের চারপাশেই আছে। ইবলিশ শয়তান এখন মানুষকে আশ্রয় করেই দুনিয়াতে তার সংঘ গড়ে তুলেছে। বর্তমান দুনিয়াতে বিশ্ব-ব্যবস্থা নির্মাণে তারা প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অনেকেই একথা হেসে উড়িয়ে দেন। কিন্তু এটি বাস্তব ও সত্য। এসব শয়তানী সংঘের কাজকর্ম একেবারে প্রকাশ্যও নয়, আবার খুব বেশি গোপনও নয়। বিশেষ করে মিডিয়া ও বিনোদন জগতকে অবলম্বন করে ‘ইলুমিনাতি’ নামে কিংবা বেনামে অনেক সংগঠন তাদের শয়তানি কাজকর্ম সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রমোট করছে। সেই নমরুদের সময় থেকে প্রাচীন মিশরে প্রচলিত বহুল ব্যবহৃত ও বহু প্রাচীন সব প্রতীক ও ইঙ্গিত মিডিয়া ও বিনোদন জগতে বহুদিন ধরে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তারা মানুষের অবচেতনে শয়তানের প্রধান প্রোপাগাণ্ডা- ‘ভালো ও মন্দ একই’ এই বাণী ছড়িয়ে দিচ্ছে।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে ব্যাফোমেটের মূর্তি যেখানে মুর্তিটি এক হাতে উপরের দিকে এবং আরেক হাতে নিচের দিকে নির্দেশ করছে। যার অর্থ As above, so below. যা আছে উপরে, তাই আছে নিচে। যা ভালো, তা-ই মন্দ। আবার আকাশে একটা সাদা রংয়ের চাঁদ উল্টো হয়ে আছে, আর মাটিতে একটা কালো চাঁদ সোজা হয়ে আছে। তার মানে, সঠিক অবস্থানের জিনিসটি উল্টো হয়ে আছে আর বেঠিক অবস্থানে থাকা জিনিসটি সোজা হয়ে আছে। এভাবে এই শয়তানের মূর্তির মধ্য দিয়ে ‘যা ভালো, তাই মন্দ’ কিংবা ‘ভালো আর মন্দের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই’- শয়তানের এই বাণী ছড়ানো হয়। আর ব্যাফোমেটের মূতির সাইন বা চিহ্ন হলো হাতের মধ্যমা ও অনমিকা আঙ্গুলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা টেনে ভাঁজ করে রেখে এবং তর্জনী ও কনিষ্ঠা আঙ্গুলকে প্রসারিত করে দেখানোর মাধ্যমে ব্যাফোমেটের মাথার আকারের ইঙ্গিত করা হয়। হাতের দ্বারা করা এই সাইন বা চিহ্ন বহু আগে থেকে বিনোদন জগতের গান-বাজনা, নাচের মধ্যে এত বেশি এবং এত বিচিত্রভাবে দেখানো হয় যে, এটি কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। বরং সচেতনভাবে এই Satanic Hand Sign দেখানোর মাধ্যমে শয়তানের বাণী (As above, so below)-কে প্রচার করে মানুষের অবচেতনে শয়তানকে প্রমোট করা হয়। মানুষকে তাকওয়া (ভাল ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার স্বাভাবিক জ্ঞান) থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাওয়া হয়। আর হেদায়াতের প্রথম শর্তই হলো তাকওয়া। তাকওয়া যদি না থাকে তাহলে হেদায়ত তো দূরঅস্ত। বর্তমান দুনিয়ায় শয়তানকে প্রমোট করার ৩টি বেসিক সিম্বলকে ঘুরে ফিরে মিডিয়াতে এবং বিনোদন জগতে এত বেশি দেখানো হয় যে তা মোটেও কাকতালীয় নয়।
সিস্বলগুলোর মধ্যে Satanic Hand Sign, এক চোখ দেখানো (বাম চোখ) এবং দাবার বোর্ডের মতো চেক প্যাটার্ন (যতগুলো সাদা ঘর, ততগুলো কালো ঘর- যত ভালো, তত মন্দ) বেশি দেখানো হয়। চেক প্যাটার্নের দ্বারা মূলত একই ব্যক্তি বা চরিত্রের মধ্যে অনেক বেশি ভালো গুণ এবং সবচেয়ে বেশি খারাপ গুণ- দুটোকেই অবলীলায় দেখানো হয়। সমাজে যেমন সাধারণভাবে একটা মানুষকে ভালো হিসেবে জানলে নিশ্চিত হতে পারি যে তার খুব বেশি খারাপ গুণ থাকা সম্ভব নয়। আবার সমাজে যে ব্যক্তি খারাপ হিসেবে পরিচিত তার খুব বেশি ভালো গুণ থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু এই চেক প্যাটার্ন দ্বারা বোঝানো হয় যে, মানুষের উচিত নিজের স্বার্থে চরম খারাপ ও চরম ভালো দুটাই প্রকাশ করা। খারাপ আর ভালো আলাদা নয়। নিদেনপক্ষে সিনেমাতে কিংবা কোনো বিনোদন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি চরিত্রতে চরম ভালো ও চরম খারাপ দুটাই দেখানো হয়। এভাবে দর্শকের মনোজগতে মানুষের পক্ষে একনিষ্ঠভাবে ভাল অথবা মন্দ হওয়া সম্পর্কে একটা ক্যাওস বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয় যাতে আমরা সাধারণভাবে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিদেরকেও সন্দেহ করতে শিখি এবং অন্যদিকে চরম খারাপ মানুষদেরকেও শ্রদ্ধাভক্তি করতে শিখি। এভাবে চিরায়ত ‘শুভ-অশুভ’ বোধ বা ‘ভালো-মন্দের’ বোধকে অসাড় করে দেওয়া হয়। মানুষের ‘তাকওয়া’ বিনষ্ট করা হয়। কারণ শয়তান জানে ‘তাকওয়া’ হলো মানুষের হেদায়াতের পথে প্রথম ধাপ- যে কথা আল-কুরআনে বলা হয়েছে। তাই শয়তান দুনিয়ার মানুষের তাকওয়াকেই সর্বপ্রথম টার্গেট করেছে এবং ইতোমধ্যেই দেশে দেশে এই ‘তাকওয়া’ বিনষ্টের কর্মসূচি সফল করেছে। আমাদের দেশের চালচোরদেরকে আর মাস্ক নকলকারীদেরকে দেখলে কি বোঝার বাঁকী থাকে যে মানুষের ন্যূনতম ‘তাকওয়া’ বা ভালো-মন্দের জ্ঞান আজ শুন্যের ঘরে নেমেছে কি নামেনি?
আমাদেরকে শয়তানের এসব প্রতীকযুক্ত সবধরনের মিডিয়া, বিনোদন ও অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকতে হবে।